– চিকেন রেজালা: ঐতিহ্য, স্বাদ আর স্মৃতির এক মোহময় মিলন
বাড়িতে কেউ আসছে, জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে, হেঁশেলে ব্যস্ততা — এমন সময়ে যদি রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে দুধ-দই-মশলার হালকা সুবাস, তাহলে বুঝে নিতে হবে কিছু স্পেশাল হচ্ছে। আর সেই বিশেষ পদ যদি হয় চিকেন রেজালা, তাহলে তো কথাই নেই।
এই পদটা এমন — ঘরোয়া অথচ রাজকীয়, মসলা কম অথচ স্বাদে গা ভাসিয়ে দেয়। চিকেন রেজালা শুধু একটা রেসিপি না, এটা একটা আবেগ, যা প্রতিটা বাঙালি উৎসব, অতিথি আপ্যায়ন কিংবা পারিবারিক স্মৃতির সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।

🏰 নবাবি উৎস থেকে বাঙালি পদের ছোঁয়া
রেজালার ইতিহাস খুব আকর্ষণীয়। মোঘল আমলে নবাবদের জন্য তৈরি হতো একধরনের সাদা ঝোলের মাটন — দুধ, কাজু, দই, ঘি দিয়ে তৈরি নরম স্বাদের এই পদকে বলা হতো “রেজালা”।
বাঙালির রাঁধুনিরা সেই রেসিপিকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে তোলে।
মাটনের জায়গায় আসে মুরগি, ঘি ও দুধের সঙ্গে মিশে যায় কেওড়া জল, পোস্ত আর খোয়া ক্ষীর।
ফলে তৈরি হয় এক অনন্য স্বাদের পদ — চিকেন রেজালা, যা আজ বাংলার বহু ঘরে উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ।
🫕 উপকরণে যত্ন আর নির্যাসে প্রেম
রেজালা রান্না যতটা দেখতে সাদামাটা, এর ভিতর ততটাই গভীরতা। প্রতিটি উপকরণ যেমন নির্ভুল হওয়া চাই, তেমনই রান্নার পদ্ধতিতে দরকার ধৈর্য আর ভালোবাসা।
📝 উপকরণ (৪-৫ জনের জন্য):
- মুরগি – ১ কেজি (medium পিসে কাটা)
- টক দই – ১/২ কাপ
- পেঁয়াজ বাটা – ১/২ কাপ
- আদা-রসুন বাটা – ২ টেবিল চামচ
- কাজু বাটা – ২ টেবিল চামচ
- পোস্ত বাটা – ১ টেবিল চামচ
- খোয়া ক্ষীর – ১ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক)
- ঘি – ২ টেবিল চামচ
- দুধ – ১/৪ কাপ
- কেওড়া জল – ১ চা চামচ
- দারুচিনি – ২ টুকরো, এলাচ – ৩টি, লবঙ্গ – ৩টি
- কাঁচা লঙ্কা – ৪-৫টি
- লবণ, চিনি – স্বাদ অনুযায়ী
- তেল – ২ টেবিল চামচ
🍳 রান্নার ধাপ – ধৈর্যের সঙ্গে রত্ন
১. মেরিনেশন: মুরগি ধুয়ে দই, আদা-রসুন বাটা ও লবণ দিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দাও। এতে মাংস নরম হবে।
২. ঘি-তেলে ফোড়ন: কড়াইয়ে তেল ও ঘি গরম করে দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ ফোড়ন দাও।
৩. পেঁয়াজ ভাজা: এরপর পেঁয়াজ বাটা দিয়ে হালকা বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজো।
4. বাদাম-পোস্ত-কষানো: এবার কাজু, পোস্ত, খোয়া ক্ষীর একসঙ্গে দিয়ে ভালোভাবে কষাও।
৫. মুরগি যোগ: মেরিনেট করা মুরগি দিয়ে মাঝারি আঁচে ১০ মিনিট কষাও যতক্ষণ না তেল ছেড়ে দেয়।
৬. দুধ ও কাঁচা লঙ্কা: এবার দুধ, চিনি ও কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে ঢেকে রাখো ২০ মিনিট।
৭. শেষে কেওড়া জল: রান্না হয়ে গেলে কেওড়া জল ছিটিয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রেখে নামিয়ে ফেলো।
🥣 চিকেন রেজালা পরিবেশন কীভাবে?
এই রেসিপি পরিবেশনের সময় পুরো প্লেটটা যেন সাজিয়ে গুছিয়ে দেওয়া যায়। পছন্দমতো:
- বাসমতি ভাত
- সাদা পোলাও
- পরোটা
- কিংবা ঘি-ভাতের সঙ্গেও জমে যায়
গরম গরম রেজালার সাথে ১টি কাঁচা লঙ্কা আর একটু ঘি ছিটিয়ে দিলেই অতিথি মুগ্ধ।
🧠 চিকেন রেজালা -র স্বাস্থ্যগুণ – স্বাদে যেমন, উপকারেও তেমন
বাঙালি খাবার মানেই শুধু তেল-মশলা নয়। সঠিক উপায়ে রান্না করলে রেজালাও হতে পারে স্বাস্থ্যকর।
🥩 উচ্চ প্রোটিন:
চিকেন শরীরের জন্য দরকারি প্রোটিন যোগায় যা পেশি গঠন ও রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
🥛 দুধ ও দই:
ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় হাড় ও দাঁতের জন্য ভালো।
🌰 বাদাম ও পোস্ত:
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সরবরাহ করে।
🌿 মসলা কম, সাদামাটা খাবার:
হজমের পক্ষে সহজ, যারা স্পাইসি খাবার খেতে পারেন না—তাদের জন্য আদর্শ।
💭 আমার শৈশবের চিকেন রেজালা স্মৃতি
আমার ছোটবেলার ঈদের দিনগুলো মানেই ছিল সকালবেলা ধূপের গন্ধ, গরম ভাতের ধোঁয়া, আর মায়ের হাতে তৈরি চিকেন রেজালা।
প্রতিবার আমি চুপচাপ রান্নাঘরের দরজার পাশে বসে থাকতাম, মায়ের পেছন থেকে তাকিয়ে দেখতাম কীভাবে ঘি ফোড়ন দিচ্ছে, কীভাবে দুধ মেশাচ্ছে, আর কেওড়ার গন্ধে ভরে উঠছে পুরো বাড়ি।
রেজালা যেন সেই মুহূর্তগুলোকেই ধরে রাখে—যেখানে খাবার কেবল স্বাদ নয়, বরং স্মৃতি।
📌 রেসিপি সংক্ষেপে – মনে রাখার জন্য:
ধাপ | কী করতে হবে |
---|---|
১ | মুরগি মেরিনেট |
২ | ঘি-তেলে ফোড়ন |
৩ | পেঁয়াজ ও বাদাম কষানো |
৪ | মুরগি দিয়ে কষানো |
৫ | দুধ, কাঁচা লঙ্কা, চিনি যোগ |
৬ | ঢেকে রান্না ও কেওড়া জল |
🎯 উপসংহার
চিকেন রেজালা এমন এক খাবার, যা স্বাদের বাইরে গিয়ে সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর স্মৃতির ভাষা বলে।
এটা শুধু মাংস আর মশলার মিশেল না — এটা অনেকটা “তুমি আমার জন্য স্পেশাল” বলার এক নীরব উপায়।
তুমি যদি এখনো রেজালা রান্না না করে থাকো, একবার বানিয়ে দেখো। হয়তো রান্নাঘরের ধোঁয়ার মাঝেই খুঁজে পাবে পুরনো কোনো ঘ্রাণ, কিংবা কারও হাতের সেই অদ্ভুত যত্ন।